প্রসঙ্গ- মধ্যপ্রাচ্যঃ রহস্য ঘেরা ইয়াজিদী সম্প্রদায়, তাদের উৎপত্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি যা জানলে আপনি অবাক হবেন। - ICT-তে জীবন গড়ি

Infotech Ad Top new

Infotech ad post page Top

প্রসঙ্গ- মধ্যপ্রাচ্যঃ রহস্য ঘেরা ইয়াজিদী সম্প্রদায়, তাদের উৎপত্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি যা জানলে আপনি অবাক হবেন।

প্রসঙ্গ- মধ্যপ্রাচ্যঃ রহস্য ঘেরা ইয়াজিদী সম্প্রদায়, তাদের উৎপত্তি, ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি যা জানলে আপনি অবাক হবেন।

Share This
বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে মধ্যপ্রাচ্যে আইএস এর উথ্থানের পর যে সম্প্রদায়টি সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে, সেই সম্প্রদায়টির নাম হল ইয়াজিদি সম্প্রদায়। এদের কম-বেশি ৫০ হাজার সদস্য আটকা পড়েছেন উত্তর-পশ্চিম ইরাকের পাহাড়ি এলাকায়। রহস্যময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কারণে ইয়াজিদিদের নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কিন্তু কারা এই ইয়াজিদি কিভাবে তাদের উৎপত্তি, কি তাদের ধর্ম বিশ্সাস, কেনই বা তাদের প্রতি অন্যান্য মুসলিমদের এত রাগ।ক্রোধ বুঝতে হলে আমাদের জানতে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ইয়াজিদিদের অবস্থান ও তাদের ধর্ম বিশ্বাস। আজকে আলোচনায় আমরা ইয়াজিদিদের নিয়ে একটু নাতিদীর্ঘ আলোচনা করব।

আইএসসহ (আগের নাম আইএসআইএল বা ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট) সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিশ্বাস, ইয়াজিদি নামটি এসেছে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার নাম থেকে। উমাইয়া বংশের দ্বিতীয় খলিফা (৬৪৭-৬৮৩) ইয়াজিদ অত্যন্ত অ-জনপ্রিয় ও ঘৃণিত এক শাসক ছিলেন। ইয়াজিদিগণও নিজেদেরকে উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার সমর্থকদের উত্তরসূরী বলে ভাবে। তবে আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, এ গোষ্ঠীর নামটির সঙ্গে খলিফা ইয়াজিদ বা পারস্যের (প্রাচীন ইরান) শহর ইয়জদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নামটি নেওয়া হয়েছে আধুনিক ফার্সি ‘ইজদ’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে দেবদূত বা দেবতা। তা থেকে ইয়াজিদি শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে, ‘ঈশ্বরের উপাসক’। ।ইয়াজিদি ধর্মবিশ্বাসটি Zoroastrian, Manichaean, Jewish, Nestorian Christian ও Islamic উপাদানসমূহের বৈপ্যরীত্যের সমন্বয়ে (syncretic combination) গড়ে উঠেছে। তারা নিজেরা বিশ্বাস করে, তাদের সৃষ্টি হয়েছে অবশিষ্ট মানবজাতি থেকে বেশ পৃথকভাবে, এমনকি তারা আদমের বংশধরও নয়। আর তাই তারা নিজেদেরকে কঠোরভাবে সেইসব লোকদের থেকে পৃথক করে রাখে, যাদের মাঝে তারা বসবাস করে। যদিও তারা ছড়িয়ে রয়েছে এবং সংখ্যায় তারা ১ লক্ষেরও কম, তথাপি তাদের রয়েছে সুসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থা; রয়েছে জাতি বা গোষ্ঠির প্রধান হিসেবে একজন আমীর বা প্রিন্স এবং সুপ্রিম ধর্মীয় প্রধান হিসেবে একজন chief shaykh.

ইয়াজিদি বা এজিদি হচ্ছে একটি কুর্দি নৃ-ধর্মীয় গোষ্ঠী, যাদের রীতিনীতির সাথে জরথুস্ত্র ধর্মমতের সাদৃশ্য রয়েছে। ইয়াজিদিগণ প্রধানত উত্তর ইরাকের নিনেভেহ প্রদেশে বসবাস করে। আমেরিকা, জর্জিয়া এবং সিরিয়াতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইয়াজিদিদের সাক্ষাৎ মেলে। ১৯৯০ সালের দিকে ইয়াজিদিদের একটা অংশ ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানীতে অভিবাসিত হয়। ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সাতটি পবিত্র জিনিস বা ফেরেশতার মাঝে এটাকে স্থাপন করেছেন। এই সাতজনের প্রধান হচ্ছেন মেলেক তাউস, ময়ূর ফেরেশতা। ইয়াজিদিদের বর্ণিত তাউসের সাথে ইসলাম ধর্মে বর্ণিত শয়তানের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এমনকি স্বর্গ থেকে শয়তান ও মেলেক
তাউসের বিতাড়নের কাহিনী একই, আদমকে সিজদা না করা।

ধর্মীয় রীতি

প্রার্থনা

ইয়াজিদিরা দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করে। নিভেজা বেরিস্পেদে (ভোরের প্রার্থনা), নিভেজা রোঝিলাতিনে (সূর্যোদয়ের প্রার্থনা), নিভেজা নিভ্রো (দুপুরের প্রার্থনা), নিভেজা এভারি (বিকেলের প্রার্থনা), নিভেজা রোজাভাবুনে (সূর্যাস্তের প্রার্থনা)। বর্তমানে ইয়াজিদিগণ শুধুমাত্র সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের প্রার্থনা করে থাকে।

সূর্যোদয়ের প্রার্থনার সময় ইয়াজিদিগণ সূর্য পূজারীদের মত সূর্যের দিকে এবং সূর্যাস্তের নামাজের সময় লালিস(ইরাকের একটি স্থানের নাম) এর দিকে মুখ করে থাকে।  দিনের সকল প্রার্থনা সূর্যের দিকে ফিরে পড়া হয়। বহিরাগতদের উপস্থিতিতে দিবসের প্রার্থনা হয় না। বুধবার হচ্ছে তাদের পবিত্র দিন এবং শনিবার বিশ্রাম দিবস।ডিসেম্বর মাসে তারা তিন দিনের রোজা পালন করে

উৎসব

লালিসে অবস্থিত সেক্স আদির মাজার
ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি হচ্ছে ইরাক এর উত্তর মসুলের লালিস এ অবস্থিত শেখ আদি ইবনে মুসাফির (সেক সাদি) এর মাজারে সাতদিনের হজ্বব্রত বা তীর্থভ্রমণ পালন। যদি সম্ভব হয় প্রত্যেক ইয়াজিদি তাদের জীবদ্দশায় একবার সেক সাদির মাজারে তীর্থভ্রমণের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। তীর্থভ্রমণের সময় তারা নদীতে গোছল করে। তাউস মেলেকের মূর্তি ধৌত করে এবং শেখ সাদির মাজারে শত প্রদ্বীপ জ্বালায়।  এই সময়ে তারা একটি ষাঁড় কুরবানী করে।

ইয়াজিদিরা ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন এবং খ্রিষ্টধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল উভয়কেই শ্রদ্ধা করে থাকে।  তাদের নিজস্ব ধর্মীয় প্রথাগুলোর বেশির ভাগই মৌখিক।  এমন ভুল ধারণাও রয়েছে যে ইয়াজিদি মতবিশ্বাস জরথুস্ত্রবাদ (প্রাচীন পারস্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও দর্শন, যার অনুসারীরা অগ্নি উপাসক ছিলেন) মতবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ব্যাপ্টিস্ট খ্রিষ্টানদের মতো ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের শিশুদের সর্বাঙ্গ পবিত্র পানিতে ডুবিয়ে দীক্ষা দেন একজন পীর। ডিসেম্বর মাসে ইয়াজিদিরা তিন দিন রোজা রাখে। পরে পীরের সঙ্গে সুরা পান করে।  সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখ ইয়াজিদিদের বার্ষিক তীর্থযাত্রার সময়। এ সময় তারা মসুল শহরের উত্তরে অবস্থিত লালেশ এলাকার শেখ আদির মাজারে গিয়ে নদীতে ওজুর মতো করে পবিত্র হয়। এ ছাড়া ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মধ্যে পশু উৎসর্গ করা এবং খতনা দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। । ইয়াজিদিদের সর্বোচ্চ দেবতার নাম ইয়াজদান। সাতটি মহাত্মার উৎস ইয়াজদান। এর মধ্যে প্রধান মালাক টাউসকে দিনে পাঁচবার উপাসনা করে ইয়াজিদিরা।

Yazidi: শয়তানের পূজারী এক জনগোষ্ঠি

ইয়াজিদি (Yazidi or Yezidi, Azidi or Izdi) সম্প্রদায়ের উদ্ভব শেখ আদি ইবনে মুসাফির (Sheikh‘Adī ibn Musāfir)এর মাধ্যমে। এই আদি, বর্তমান লেবাননের বা’কা উপত্যাকায় (Beqaa Valley) ১০৭০ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উমাইয়া খলিফা মারওয়ান বিন আল-হাকামের একজন উত্তরসূরী।  তিনি বালবেকের নিকটস্থ বৈৎ ফার (Bait Far) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সেখানে তার জন্মগ্রহণ করা গৃহটি আজও রয়েছে, আর তা এখন ইয়াজিদিগণের পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত।  ইয়াজিদিগণ আদিকে “তাউস মালেক” বা ময়ূর ফেরেস্তার একজন অবতার বা দেবতা হিসেবেই বিবেচনা করে।  ইরাকের লালিশে অবস্থিত তার সমাধিটি ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থস্থান।

Tawûsê Melek বা ময়ূর ফেরেস্তা
শেখ আদি তার জীবনের প্রথম দিকের অধিকাংশ সময়টা বাগদাদে কাটিয়ে দেন। সূফি জীবন-যাপন এবং একাকী তপস্যার লক্ষ্যে তিনি কুর্দিস্থানের একটি শান্ত এলাকা বেঁছে নেন। ঐ এলাকাটি আদিবাসী ইরানী ধর্মীয় আন্দোলন যেমন, জরথুস্ট্রবাদের (Zoroastrianism) সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।  নি:সঙ্গ একাকী জীবন-যাপন ছাড়াও তিনি তার তপশ্চর্যা ও আলৌকিকতা দ্বারা স্থানীয় লোকদেরকে প্রভাবান্বিত করেন। বলা হয়ে থাকে, আদি ছিলেন মধ্যম মর্যাদার এবং অনেক পরিশোধিত। ইয়াজিদিগণ তাকে বসিয়ে দেন তাদের জাতীয় গুরুর (national saint) আসনে।  আদি স্মরণীয় ও বরণীয় ছিলেন তার সন্যাস জীবন-যাপনের জন্যে। তিনি একটি ধর্মপ্রথার প্রবর্তন করেন এবং তার অনুসারীগণ তার নামানুসারে “al-Adawiya” হিসেবে পরিচিত। তিনি মসূলের উত্তরে Hakkari Kurds পর্বতে নিজ আশ্রমে বসবাস করতেন এবং ১১৬০-৬২ সিইতে ৯০/৯২ বৎসর বয়সে সেখানেই মারা যান। তার মৃত্যুর পর, তার উত্তরসূরীগণ সেখানেই বসবাস করতে থাকে।

আদির সমাধিটি বদরী পল্লীর মাঝে তিনটি কৌণিক গম্বুজ দ্বারা সহজ নির্দেশিত।  উৎসবের সময় তার সমাধিস্থলে অনেক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। রাত্রীকালীন টর্চলাইট শোভাযাত্রা, সবুজ pall (যা দিয়ে সমাধিটি আচ্ছাদিত করা হয়েছে) এর প্রদর্শনী, বড় বড় খাঞ্চায় ধোঁয়া ওঠা হারিশার (ঘন দুধে ছোট ছোট টুকরার মাংস বা সবজি রান্না) পরিবেশন ঐ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তার অনুসারীগণ বিশ্বাস করে- তিনি ঈশ্বরের একজন অবতার। E.S. Stevens তার “Tigris and Euphrates” পুস্তকে শেখ আদির সমাধি মন্দিরের বর্ণনা দিয়েছেন এমন-

শেখ আদির সমাধি।
“প্রবেশ দ্বারের সম্মুখ প্রাঙ্গনটিতে বিভিন্ন ধরণের ছোট ছোট ইমারত রয়েছে। মালবেরী গাছের ফাঁক গলে সূর্য্যরশ্মি সেগুলির বহির্ভাগ ও প্রাঙ্গনে চৌকোণাকার নকশা তৈরী করেছে। প্রবেশ দ্বারটি দেয়ালের সর্ববামে। পাথরে খোঁদিত অদ্ভূত যাদুকরী চিহ্নের কারণে সেটি বেশ কৌতুহল উদ্দীপক। আর এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে বৃহৎ এক উলম্ব সর্পের প্রতিকৃতি। সতর্কতার সাথে কাল রঙে রঞ্জিত এই প্রতিকৃতিটি বসান হয়েছে প্রবেশ দ্বারের দক্ষিণে। পূণ্যার্থীগণ শয়তানের এই প্রতিকৃতিতে চুম্বন দেয়। মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ অন্ধকার, নোংরা ও স্যাঁতস্যাঁতে। ...আর প্রদীপের ফোঁটা ফোঁটা তেল পড়ে মেঝেও বেশ পিচ্ছিল।

ধর্মগুরুর আশীর্বাদ।
মন্দিরের উত্তরপাশে রয়েছে একটা বেঁদী বা চ্যাপেল, এটিকে তারা "শেখ হাসান" বলে অভিহিত করে। এখানে রয়েছে নৌকার আকৃতির একটি সিন্দুক বা সমাধি, যার উপরে বিছান রয়েছে সিল্কের কাপড়, আর তার ঝালর ঢেকে ফেলেছে সেটির চারিধার। এখান থেকে আবার একটা নীচু দরজা দ্বিতীয় আর একটা চ্যাপেলের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে শেখ আদির নিজের সমাধি।”

Tawûsê Melek বা ময়ূর ফেরেস্তা (Peacock Angel)-কে কেন্দ্র করে ইয়াজিদি ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে এলাকায় এই ময়ূর ফেরেস্তার উপাসনা করা হয়, সেখানে কিন্তু এই ময়ূর স্থানীয় নয়। যাইহোক, এই ময়ূর ফেরেস্তা আর কেউ নন, স্বয়ং আযাজিল বা ইবলিস। ইয়াজিদি বিশ্বাসের ভিত্তি Black Book “Kitêba Cilwe” বা “Book of Illumination”-কে মালেক তাউসের বাণী বলে বিশ্বাস করা হয়। ঐ কিতাবে বলা হয়েছে- “I was present when Adam was living in Paradise, and also when Nimrod threw Abraham in fire.”

শয়তানের প্রতিমুর্তি
ইয়াজিদি বিশ্বাস মতে খোদা বিশ্ব সৃষ্টির পর তা সাত পবিত্র আত্মা বা ফেরেস্তার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেন। এই সপ্তকের মধ্যে প্রধান ছিলেন তাউস মালেক বা ময়ূর ফেরেস্তা। এই তাউস মালেককে মুসলিম এবং খৃষ্টানগণ শয়তান হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন। অন্যদিকে ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে, তিনি অমঙ্গল বা wickedness -এর উৎস নন। তারা তাকে পতিত ফেরেস্তা নয়, বরং ফেরেস্তাগণের নেতা হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি “শয়তান” শব্দ উচ্চারণ এবং বলা তাদের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা এমন ধারণা পোষণ করে যে, মানুষের নিজের হৃদয় এবং আত্মার মধ্যেই অমঙ্গলের উৎস, তাউস মালেকের মধ্যে নয়।  এই ধর্মের মূল চালিকা শক্তি তাউস মালেক ও শেখ আদি।

ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে তাউস মালেক খোদারই প্রতিরূপ এবং একজন হিতৈষী ফেরেস্তা। তিনি নিজেকে তার পতন থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং পরে সৃষ্টিকর্তারূপে আবির্ভূত হন। তিনি Cosmic egg থেকে cosmos সৃষ্টি করেন। অনুশোচনার পর তিনি ৭,০০০ বৎসর ক্রন্দন করেন। তার চোখের জলে ৭টি পাত্র পূর্ণ হয়, আর তা দোযখের আগুনকে নির্বাপিত করে ফেলে। ফলে ইয়াজিদি বিশ্বাসে নরকের কোন স্থান নেই।

তাউস মালেক।

ইয়াজিদি বিশ্বাস মতে তাউস মালেক প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তব্য, কল্যাণ ও আশীর্বাদ এবং দূর্ভাগ্য বন্টন করেন তেমনই, যেমন তার ইচ্ছে। আর তাই এ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করা কারও জন্যে জায়েজ নয়। শেখ আদি আরও বিশ্বাস করতেন তার আত্মা ও তাউস মালেকের আত্মা একই, বলা যায় একই আত্মার নূতন দেহধারণ।  ইহুদি, ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলাম থেকে ইয়াজিদি ধর্মমতে সৃষ্টি তত্ত্বে ভিন্নতা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে খোদা সর্বপ্রথম তাউস মালেকে সৃষ্টি করেন তাঁর নিজের রূহানী থেকে এবং তাকে অন্য কোন সৃষ্টিকে সিজদা না করার নির্দেশ দেন।  এরপর খোদা অন্যান্য ছয় প্রধান ফেরেস্তাকে সৃষ্টি করেন এবং তাদেরকে পৃথিবী থেকে মাটি সংগ্রহের নির্দেশ দেন। তারা তা নিয়ে এলে তিনি ঐ মাটি দিয়ে আদমকে সৃষ্টি করেন এবং নিজের শ্বাস ফুঁকে দিয়ে তাকে জীবন দেন। এরপর তিনি ফেরেস্তাদের নির্দেশ দেন আদমকে সিজদা করার। এই নির্দেশ তাউস মালেক ছাড়া সকলেই পালন করে। খোদা তাকে সিজদা না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তাউস মালেক উত্তরে বলেন- “How can I submit to another being! I am from your illumination while Adam is made of dust.” তখন খোদা তার প্রশংসা করেন এবং সকল ফেরেস্তাদের সর্দার করে দেন। এরপর তাকে পৃথিবীতে তাঁর ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ দেন।


যদিও এ ঘটনায় শয়তানের গর্বীয় পাপের নিদর্শণ দেখা যাচ্ছে, তথাপি ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে যে তাউস মালেক পৃথিবীতে খোদার প্রতিনিধি এবং নিশান বা এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার তিনি ধরায় আগমন করেন। আর তারা আরও বিশ্বাস করে যে, খোদা এদিনই তাউস মালেকে সৃষ্টি করেছিলেন। এ কারণে তারা দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে উৎযাপন করে।

ইয়াজিদিগণ যুক্তি দেখান যে, আদমকে সিজদা করার আদেশ তাউস মালেকের জন্যে কেবলমাত্র একটা পরীক্ষা ছিল। কেননা, খোদা কোনকিছু আদেশ করলে তা অবশ্যই ঘটে।  আর বাইবেল ও কোরআনও এমনটাই বলে।  অন্য কথায়, God could have made him submit to Adam, but gave Tawûsê Melek the choice as a test. তারা বিশ্বাস করে যে, Tawûsê Melek এর জন্যে তাদের সম্মান এবং প্রশংসা is a way to acknowledge his majestic and sublime nature. আর এই আইডিয়াকে বলা হয়, “Knowledge of the Sublime”-(Zanista Ciwaniyê). অন্যদিকে, শেখ আদির আত্মা, তাউস মালেকের আত্মার প্রতিরূপ হওয়ায়, আদি তাউস মালেকের কাহিনী নিজে অবলোকন করেছেন এবং তার উপর বিশ্বাস এনেছেন।

ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করে, ভাল এবং মন্দ প্রতিটি মানুষের মনে এবং আত্মায় বর্তমান রয়েছে। মানুষের নিজের উপরই নির্ভর করবে সে কোনটি বেঁছে নেবে। আর তাই তাউস মালেকের প্রতি অনুগত হওয়া তাদের একান্ত জরুরী, কেননা, খোদা ভাল ও মন্দের মধ্যে একটিকে বেঁছে নিতে তাকে একই চয়েস দিয়েছিলেন এবং তিনি ভালটাকে বেঁছে নিয়েছিলেন। ইয়াজিদিগণ আরও বিশ্বাস করে যে, তাদের ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আদি ইবনে মুসাফির, তাউস মালেকেরই প্রতিরূপ।

খৃষ্টান, মুসলিম এবং অন্যান্যরা তাউস মালেকে Lucifer বা শয়তান হিসেবে সনাক্ত করে থাকেন।  অন্যদিকে ইয়াজিদি পবিত্র গ্রন্থ ব্লাক বই অনুসারে, ইয়াজিদিদের জন্যে “শয়তান” নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ।  কেননা, their people would be religiously persecuted by other faiths.

মসূলদাম বাঁধের নিকট এক ইয়াজিদি শহর।
আর্মেনিয়াতে, যেখানে ইয়াজিদিগণ তাদের আর্মেনিয়ান ক্রিশ্চিয়ান প্রতিবেশীদের মাঝে মুসলিম শত্রুদের থেকে আত্মরক্ষা করে বংশবিস্তার করেছিল, সেখানে তারা বর্তমানে only significant ethnic minority.-এতক্ষণ যে তথ্যের অবতারণা করা হয়েছে তা মোটামুটি Wikipedia’র সারাংশ। এখন আমরা দেখব এদের সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য ভান্ডার কি বলে-

সানজাক
ইয়াজিদিগণের নিকট প্রধান ঐশ্বরিক চরিত্র হচ্ছে মালেক তাউস।  আর তাকে উপাসনা করা হয় ময়ূর রূপে কল্পনা করে। তিনি অন্য আর ছয় ফেরেস্তা নিয়ে মহাবিশ্ব শাসন করেন। কিন্তু এই সাতজনের সকলেই সর্বশক্তিমান খোদার অধিনস্ত। তিনি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার পর থেকে এর প্রতি সরাসরি আর কোন আগ্রহ দেখাননি। ইয়াজিদিগণ সাত ফেরেস্তাকে উপাসনা করে তাম্র বা লৌহের তৈরী সাতটি ময়ূরের মূর্ত্তির আকারে, যাকে বলা হয় sanjaq. আর এর সবচেয়ে বড়টির ওজন প্রায় ৭০০ পাউন্ড।

ইয়াজিদিগণ দ্বৈতবাদ বিরোধী। তারা অশুভ বা evil-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। আর তাই তারা প্রত্যাখ্যান করে পাপ, শয়তান এবং নরককে। তাদের মতে, ঐশ্বরিক আইন অমান্য বা ভঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত হয় পুনর্জন্ম বা আত্মার দেহান্তরের মাধ্যমে, যা আত্মাকে উত্তরোত্তর পরিশোধনে সাহায্য করে। ইয়াজিদিগণ আরও বলে থাকে, যখন Tawûsê Melek খোদার নিকট তার গর্বের দরুণ পাপের অনুশোচনা করে, তখন তাকে ক্ষমা করা হয় এবং ফেরেস্তাদের নেতার পূর্বপদ তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর এই উপাখ্যান (myth)-ই ইয়াজিদিগণকে অন্যদের নিকট শয়তানের পূজারী হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে। ইয়াজিদিগণ আরও বিশ্বাস করে, তাদের প্রধান ধর্মীয় গুরু শেখ আদি, পুনর্জন্মের মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব লাভ করেছিলেন।

শেখ আদির সমাধি মন্দিরের একাংশ।
ইয়াজিদি ধর্মের প্রধান কেন্দ্র শেখ আদির সমাধিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এবং বাৎসরিক উৎসব উৎযাপিত হয় এই সমাধিস্থলেই। আদির এই সমাধিটি মসূলের উত্তরে, Ash-Shaykh ‘Adi শহরের প্রাক্তন নেস্তোরিয়ান খৃষ্টান আশ্রমে অবস্থিত। আরবীতে লিখিত দু’টি পুস্তিকা, Kitab al-jilwah (“Book of Revelation”) ও Mashaf rash (“Black Book”), ইয়াজিদিগণের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। আর শেখ আদিকে প্রশংসা করে লিখিত আরবী স্ববগানও (Arabic hymn) সম্মানের সাথে পঠিত হয়।

ইয়াজিদিগণ মসূল থেকে ককেশাস অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে।  এদের সংখ্যা ৫০,০০০এর মত। তারা নিজেদেরকে Dasni হিসেবে পরিচয় দেয় এবং কুর্দিশ উচ্চারণে কথা বলে। তাদের সম্প্রদায়ের প্রধান হচ্ছেন একজন খলিফা, যিনি শেখ আদির একজন উত্তরসূরী। তার অধীনে রয়েছে sheikh, kavval, ও faqir-গণ। পৌরোহিত্য পুরুষানুক্রমিক। তাদের নৈতিকতা, ঐ এলাকার গড় নৈতিকতার উপরে। তারা সাহসী এবং ধূর্ত। তাদের মেজাজ প্রফুল্ল কিন্তু শান্ত। আর তারা পরিচ্ছন্ন স্বভাবের। তাদের মহিলারা বোরখা পরে না এবং হয়ত: অপরিচিতদেরও অভ্যর্থনা জানায়। নীল রং এর প্রতি তারা বড় ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখায়। পুরোপুরি অশিক্ষিত হওয়ায়, তারা তাদের প্রথা ও ঐতিহ্য মৌখিকভাবে বংশ পরস্পরায় এগিয়ে নিয়ে যায়।

শেখ আদির সমাধি, উৎসবের সময়।
তাদের প্রধান উৎসব ১০ই অগাস্ট। ঐদিন আত্মনিগ্রহকারীগণ সাঁরি বদ্ধভাবে বদরী গ্রামের (village of Ba’adri) দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে রয়েছে তাদের প্রধান ধর্মীয় গুরু শেখ আদি বিন মুসাফিরের সমাধি। আর তার চারিদিকে ন্যাপথা ও বিটুমিন প্রজ্জ্বলিত করে রাখা হয়।।  ইয়াজিদি শব্দের উৎপত্তি বহুল আলোচিত। খুব সম্ভবত: এর সম্পর্ক রয়েছে Av.Yazata’র, যার অর্থ উপাস্য বা দেবতা, “deity”, আবার পার্স্যিয়ান Yazdan অর্থ খোদা, “God”. আর এটাই তাদেরকে জরথুষ্ট্রবাদী বা মুসলিমদের থেকে পৃথক করেছে। যদিও তাদের পুরোহিত সম্প্রদায় মুসলিমদের অনুরূপ এবং তারা মুহম্মদ এবং ইব্রাহিমকে নবী হিসেবে স্বীকার করে, কিন্তু তাদের রীতিনীতি মুসলিম ধর্ম থেকে বড় রকমের পৃথক। আবার তারা নেস্তোরিয়ান খৃষ্টানও নয়, যদিও তারা বাপ্তাইজ করে এবং খৃষ্টকে ফেরেস্তার মানবীয় রূপ হিসেবে বিবেচনা করে। বস্তুত: তারা পারস্যিয় ও অশুরীয় উপাদানের সাথে মাজিবাদের বিভিন্ন মতবাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। যেমন, তাদের অগ্নি উপাসনা পার্স্যিয়ান। They profess that the devil is a creative agent of the supreme God,inasmuch as he produced evil. আর তাই ভক্তি-শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য।

ইয়াজিদি তরুণী।
ইয়াজিদিগণ বলে থাকে- খোদা পৃথিবীকে সুন্দর করে তৈরী করেছিলেন। তারপর Melek Taus তাঁর সম্মুখে হাজির হয়ে বলেন, অন্ধকার ছাড়া আলো অর্থহীন, রাত ছাড়া কোন দিন হয় না। আর এভাবেই he caused night to follow day.

Dr. R.C. Zaehner তার “The Hutchinson Encyclopaedia of Living Faiths” পুস্তকে ইয়াজিদি ধর্ম বিশ্বাসকে, “aberrant form of the Sufi movement” হিসেবে বিবেচনা করেছেন। অন্যদিকে Joseph T. Parfit তার “Marvellous Mesopotamia” বইতে লিখেছেন-
ইয়াজিদি বা শয়তানের উপাসকগণ মসূলের নিকটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক গ্রামে এবং Sinjar পর্বতে বসবাস করে।  তাদেরকে দেখলে কুর্দি বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। তারা কথা বলে কুর্দি এবং আরবীতে। প্রায় ৪০ হাজারের মত ইয়াজিদি মেসোপটেমিয়াতে রয়েছে এবং ছয় হাজারের মত ককেশাসে। তাদের হেডকোয়ার্টার প্রাচীন নিনেভের উত্তর-পূর্বে একটা ভৌতিক এলাকা (weird place)- শেখ আদিতে।  তাদের বেশ কিছু অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য বা বলা চলে মহৎ গুণ রয়েছে, তথাপি তারা অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত ও নিগৃহীত। তাদেরকে “Devil worshippers” বলা পুরোপুরি সঠিক নয়। কেননা, তারা সর্বশক্তিমান খোদায় বিশ্বাস করে, যিনি সৃষ্টি করেছেন এই মহাবিশ্ব। কিন্তু তারা শয়তানকে “Prince of this world”- হিসেবে ভিন্নভাবে মূল্যায়ণ করে, যেন তার প্রতিহিংসায় তারা না পড়ে।  তারা মূলত: যে সকল শব্দের আদ্যোক্ষর Satan নামের আদ্যোক্ষরের সাথে মিলে যায় তা পরিহার করে এবং পরিবর্তে সমার্থক আরবী শব্দ ব্যবহার করে।  এভাবে তারা devil বা শয়তান সম্পর্কে কথা বলার সময় তাকে “Prince of Darkness”, “Lord of the Evening” বা the “Exalted Chief” বলে সম্বোধন করে। অনেক ইয়াজিদি practise baptisms; make the sign of cross, and kiss the threshold of Christian Churches.

১৮৫০ সনে আদির সমাধি মন্দির, লালিশ, ইরাক।
আবার, Wigram and Wigram ইয়াজিদিদের সম্পর্কে লিখেছেন: ইয়াজিদি বা শয়তানের পুজারীগণ (“Devil worshippers”) প্রধাণত: বাস করে মসূল প্রদেশে। তারা যে শয়তানের পুজারী এতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, তারা নিজেরা স্বীকার করতে কোন সঙ্কোচ করে না যে, ঐ সত্বা যার প্রসন্নতা তারা কামনা করে এবং তাকে তুষ্ট রাখতে চায়, সে ইহুদি, খৃষ্টান ও মুসলিমদের নিকট শয়তান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সৌভাগ্য ক্রমে আশেপাশের নৈতিকতা, তাদের সম্মন এ ধারণা পোষণ করতে বাঁধা দেবে। সত্যি বলতে কি, তাদেরটা কেবল একটা ধর্মীয় বিশ্বাস, কোন কাজের মাধ্যমে এর কোন বহি:প্রকাশ নেই।
ভাল থাকবেন সবাই আগামীতে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আরও লেখালেখির ইচ্ছা আছে।  লেখার আপডেট পেতে আমাদের পেইজে লাইক দিয়ে রাখুন।

No comments:

Post a Comment

Infotech Post Bottom Ad New

Pages