প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করুন - ICT-তে জীবন গড়ি

Infotech Ad Top new

Infotech ad post page Top

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করুন

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করুন

Share This

পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী তার কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জন করতে পেরেছে কি না, তা তার শিক্ষকই যাচাই করতে পারেনপঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী তার কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জন করতে পেরেছে কি না, তা তার শিক্ষকই যাচাই করতে পারেনদার্শনিক প্লেটোর মনে একটি প্রশ্ন খুবই খোঁচা দেয়। একটি দেশে থাকে নানা পেশার, নানা ধরনের লোক; সবাই মিলে দেশটিকে কীভাবে ভালোবাসবে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্লেটো হাজির হলেন তাঁর ওস্তাদ মহামতি সক্রেটিসের দরবারে। সব শুনে সক্রেটিস বললেন, ‘ওরে পাগলা, দেশের চিন্তা বাদ দে।’ ভ্যাবাচেকা খাওয়া প্লেটোর দিকে হেসে তিনি বললেন, ‘আলাদা করে দেশকে ভালোবাসার দরকার নেই। যার যা কাজ, সেটিই যদি ঠিকভাবে করা হয়, তাহলেই দেশকে ভালোবাসা হয়। সেটাই সর্বোত্তম দেশপ্রেম।’

গুরু-শিষ্যের এই কথোপকথন কদিন ধরে মনে পড়ছে আমাদের পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে। শিক্ষাবর্ষের তিন ভাগের এক ভাগ সময় চলে যাওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার (পিইসি) শিক্ষার্থীরা জেনেছে, এবার তাদের প্রশ্নপত্র হবে অন্য রকম। ‘বহুনির্বাচনি প্রশ্ন (এমসিকিউ) রেখে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠামো ও নম্বর ঠিক করেছিল জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি। এর দেড় মাস পর ২ এপ্রিল এমসিকিউ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আরও ১০ দিন পর নতুন নিয়মে প্রশ্নপত্রের কাঠামোর আদেশ জারি হয়। অর্থাৎ শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রায় সাড়ে তিন মাস চলে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা জানল পরীক্ষায় এমসিকিউ থাকবে না।’ (প্রথম আলো, ২০ মে ২০১৮)।

পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতি বদলানো যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনটা কেন হচ্ছে? কারা এ পরিবর্তন করতে বলেছে? পত্রিকায় দেখলাম পাবলিক পরীক্ষায় এমসিকিউ তুলে দেওয়ার জন্য লিখিত সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ! জি, প্রিয় পাঠক, এই সুপারিশ দুদকেরই, কোনো শিক্ষা কমিশনের নয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়া দুদকের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, ‘পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হতে হবে সৃজনশীল ও বর্ণনামূলক। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষায় বিদ্যমান বহুনির্বাচনি প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতি বাতিল করা যেতে পারে।’ (প্রথম আলো অনলাইন, ১০ এপ্রিল ২০১৮)। 
আমার যত দূর মনে পড়ে, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এই তথাকথিত পাবলিক পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্তটিও কোনো গবেষণাপ্রসূত নয়। যে 
সময় প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য এই পরীক্ষার বিধান ছিল না। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই পরীক্ষা দেশের কোটি কোটি ছেলেমেয়ের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। এর ফলে কি শিক্ষার উন্নতি হয়েছে? না। বরং কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নকল করতে শিখছে, তাদের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে।

গণিত অলিম্পিয়াডের কারণে দেশের গণিত শিক্ষার হালহকিকত সম্পর্কে আমাকে কিছুটা ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেরও প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছে কি না, তা দেখার জন্য ২০১১ সাল থেকে বাংলা ও গণিতে তাদের দক্ষতার একটি পরিমাপ করা হচ্ছে। ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (এনএসএ) নামের এই কার্যক্রম প্রতি দুই বছর অন্তর হয়। তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে বাছাই করে তাদের দক্ষতার পরিমাপক পদ্ধতিটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ২০১১ সালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ ৬৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৫ শতাংশ, আর ২০১৫ সালে দেখা যাচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির কাঙ্ক্ষিত গাণিতিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ! তার মানে, বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই গণিতের কিছুই শিখছে না।

গণিতের পাশাপাশি সাক্ষরতার কথাও ধরা যেতে পারে। একই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০১১ ও ২০১৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৭৫ ভাগই বাংলা ভাষায় তাদের কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। ২০১৫ সালে এ হার বেড়ে হয়েছে ৭৭ শতাংশ।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মুখোমুখি হওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রসমূহ তাদের নতুন প্রজন্মকে নানাভাবে তৈরি করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) আগামী দিনগুলোর জন্য যেসব দক্ষতাকে নিয়ামক বলে ঘোষণা করেছে, মুখস্থবিদ্যা তার মধ্যে নেই। কিন্তু মুখস্থবিদ্যা জাহিরই আমাদের পাবলিক পরীক্ষার প্রধানতম হাতিয়ার।

আগামী প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে সমস্যা সমাধানকারী (প্রবলেম সলভার) হিসেবে। এ জন্য তার থাকতে হবে সৃজনশীলতা, ক্রিটিক্যাল চিন্তা করার দক্ষতা, অনিশ্চয়তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহস এবং দলীয়ভাবে কাজ করার যোগ্যতা। এসবের জন্য শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে অনেক অনেক বেশি দলীয় কাজ, সমস্যা সমাধানের জন্য তৈরি করা প্রয়োজন। সেভাবেই প্রায় সব দেশই পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত ফিনল্যান্ডে ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পাবলিক পরীক্ষায় বসতেই হয় না। 
পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ একজন শিক্ষার্থী তার কাঙ্ক্ষিত শিখন ফল অর্জন করতে পেরেছে কি না, তা তার শিক্ষকই যাচাই করতে পারেন। সে জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষা ও যাচাই পদ্ধতির আধুনিকায়ন দরকার। প্রতিদিন পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে না।

মনে রাখতে হবে, কেবল মুখস্থ করার মাধ্যমে সৃজনশীলতার বিকাশ হয় না এবং পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে অজানা একটি বিষয়ে লিখতে দেওয়ার নামও সৃজনশীলতা নয়। এই বয়সে একজন শিশুকে ঠিকমতো খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, আনন্দ-ফুর্তি করতে না দিলে তার মধ্যে সৃজনশীলতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কিছুই গড়ে উঠবে না। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা শিশুকে কেবল মাঠ থেকেই তুলে আনেনি, বরং তাকে ঘরে বন্দী করে পাঠ্যপুস্তকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। বছরের প্রথম দিন থেকেই তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া। এই সময়ে তার অন্যান্য বই পড়ার যে অভ্যাস গড়ে ওঠার কথা ছিল, সেটি চাপা পড়ে যাচ্ছে গৃহশিক্ষকের বানিয়ে দেওয়া নোটের নিচে! পত্রপত্রিকাগুলোও বছরের প্রথম দিন থেকে তাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘উঁহু। তোমার কিন্তু সমাপনী পরীক্ষা আছে।’

গত ১০ বছরে প্রায় দুই কোটি শিশুর শৈশব আমরা নষ্ট করেছি। তাদের সেই শৈশব ফিরিয়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। কিন্তু নতুন দুই কোটির শৈশব আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি যদি এই অহেতুক এবং মূল শিক্ষানীতিতে অনুপস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা আমরা বাতিল করি।

মুনির হাসান বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক

সূত্রঃ প্রথম আলো

No comments:

Post a Comment

Infotech Post Bottom Ad New

Pages